রবিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৪

বিভাবসু এবং বিভাবরী






গর তিলোত্তমা রয়েছে সুবর্ণ নগরের গনিকালয়েও।
মেহেদী তার হাতেও উঠে। সানাই সেও শুনে তবে সেটা কোন আয়োজনের জন্য নয়। এই ঘরানার থার্ডক্লাস টাইপের মেকাপ বক্সও থাকে তার পার্সে। অভিনয়ে মন জয় করবার জন্য নয়, সেটা বিনিময়ের জন্য। দুরন্ত কিশোরীর মতো সে ও শিস মারতে জানে। তফাৎ এই যা, ‘ঘরনী’ লেবেল আঁটা আর তিলোত্তমারা লেবেল বিহীন। ছিপি না খোলা পর্যন্ত বোতলের স্বাদ অনুভব করা যায়না। কৌমার্য হাতে নিয়ে উড়নচণ্ডী! অনেকে ছিপি খোলবার আগেই বিবসন হয়ে যায়। তিলোত্তমাদের তাতে কোন ভ্রুকুটি নেই, নরাধম কে উত্তম-মাধ্যম দেবার ইচ্ছেটুকু তারা বেঁধে রেখে দিয়েছে মধ্যমায়।

‘ঘরনী’ যদি নক্ষত্রের মতো হাজার ইচ্ছের পাতা মনে পুষে বিভাবসু হয়, বিমুখ গনিকা তবে বিভাবরী। সে নিজেকে বিরজা ভাবতে পারেনা, কেননা তা হতে নেই। লক্ষনাক্রান্ত রঙটা যেন শুধু ঘরনীর একার। লৌকিকতায় হয়তো নগর তিলোত্তমা’রা কখনই সামিল হয়না। তবুও বেঁচে থাকার জন্য তস্কর হয় ক্ষণে ক্ষণে। উনিশ কুঁড়ির কৌমার্য হরণকারিনীও বলা যায় খানিকটা।

যুগ চলে যায়। গলি বদলায়। রয়ে যায় এই নগর তিলোত্তমা, যাদেরকে জন্ম দিই আমাদের মতোই কেউ কেউ। যাদেরকে এড়িয়ে চলি। আমাদের মতোই কিছু পামর! আবার শিস বাজাই তিলোত্তমাদের জন্য।

শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৪

যে কথা বলা হয়নি






-নীল; তুমি কচুরীপানা দেখেছো ?
ভরা পানিতে কেমন ভেসে থাকে;
রমণীরা আলতো ছোঁয়ায়
তাকে কাছে টেনে নেয়; তাকে সৌন্দর্যের এক ভাস্কর্য-
মনে করে কেউবা নানা উপমায় সাজায়;

কিন্তু সে ফুল কেউ অন্দর মহলের শোভা বর্ধনে সাজায় না।
ওরা খুব জোড়া বেধে থাকতেই ভালোবাসে;
একা থাকতে চায়না।
-নীল আমি সেই কচুরী পানার মতোই
নিপুন হাতে গড়া জীবন্ত ভাস্কর্য
যার ভেতরে আনন্দ আছে, ব্যাথা আছে,
বিবর্ণ হবার আকাঙ্খা আছে; কিন্তু প্রেম নেই।

যার বুকে ভালোবাসাই নেই তাকে কি ভালোবাসা যায় বলো ?

-নীল আকাশের সীমানা যদি মেপে ফেলা যেত,
তাহলে তাকে অসীম বলার কি’ই বা প্রয়োজন থাকতো বলো।

আমি অথৈ গভীরতা সমান আনন্দ বুকে নিয়ে বসে আছি;
যদি চাও তো নিতে পারো পাহাড় সমান।
-নীল দেয়ালিকার মতো সাদা কাগজ রেখেছি বুকের এই মাঝ খানে
তুমি একে চলো যেমন খুশি তেমন, আমি বাধা দেব না।
হাতের তালুতে রেখে দিয়েছি আঁকা বাকা এক নদী;
সেখানে আমার ভাগ্য দেবতা রোজ লুকোচুরি খেলে।

তোমার পূর্ণ চোখ মেলে দাও এই ভাগ্য রেখার বালুচরে;
পাবে অনন্ত দিগন্ত; তুষারপাত; টানা বারান্দার কথোপকথন;
কিন্তু সেখানে এক বিন্দু প্রেম তুমি পাবে না !!!

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৪

অনিলা-১









অনিলা, তুমি ভাবতেই পারবে না;
যে শহরে তুমি ফেলে যাওয়া দিনগুলোতে নিয়ন আলো দেখতে পাওনি।
সে শহর আজ কেমন সেজে আছে!
সে শহরে আজ শুধু আলোর ঝলকানিই দেখতে পাচ্ছি।
এত্তো আলো এই শহরে এখন, অথচ রোজ মোমবাতি জ্বেলে প্রার্থনা ঘরে যেতাম আমরা।
আমাদের যখন সেই তুলসী তলায় কেত্তন হতো;
দেখতাম তুমি তখন সুর করে কোরআনের বাণী আওরাচ্ছ।

পাশাপাশি আমরা তবুও কি যেন একটা দেয়াল!

বৃষ্টির দিনে মোমের আলো পাশে রেখে ছায়াবাজি খেলতাম।
ঘরে তখন মাঝে মাঝে গ্যাসের বাতি জ্বলত।
তখনও বিদ্যুৎ আসেনি এই শহরে, আমাদের দিনগুলো তখনও যান্ত্রিক হয়ে উঠেনি।
আমরা তখনও বিষাদের ছায়া গায়ে মাখতে শিখিনি।
তখন অবদি আমরা ভাবতাম এক সাথেই আমাদের দিন গুজরান হবে সকলের।
কিন্তু, হয়ে উঠেনি আর আমরা এলোমেলো হয়ে গেছি খুচরা পয়সার মতো।


বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৪

পুরোনো কিছু বইয়ের কথা





“মেমসাহেব”
লিখেছেন : নিমাই ভট্টচার্য
প্রথম প্রকাশ : শ্রাবণ ১৩৭৩ বাংলা।
প্রকাশনায় : দে’জ পাবলিশিং / কলিকাতা ৭০০০৭৩।
বইটির মূল্য:৭০টাকা মাত্র।
বইটির ধরনঃ দুর্দান্ত একটি প্রেমের উপন্যাস।


মেম সাহেব বইটির কিছু অংশ এখানে দেয়া হলোঃ

বইটির শুরুতেই আছে এই একটা দারুন কবিতার লাইন.........

“ যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক,
তারা তো পারেনা জানিতে।
তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ,
আমার হৃদয় খানিতে। ”


বইটির ১২ তম পৃষ্টায় লেখা আছে,

সেদিন কি তিথি, কি নক্ষত্র , কি লগ্ন ছিল তা আমি জানিনা। জীবন-নদীতে এত দীর্ঘদিন উজান বাইবার পর বেশ বুঝতে পারছি যে সেদিন বিশেষ শুভলগ্নে আমি পৃথিবীর প্রথম আলো দেখি নি। এই পৃথিবীর বিরাট ষ্টেজে বিচিত্র পরিবেশে অভিনয় করার জন্য আমার প্রবেশের কিছুকালের মধ্যেই মাতৃদেবী প্রস্থান করলেন। একমাত্র দিদিও আমার জীবননাট্যের প্রথম অঙ্কেই জামাইবাবুর হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি কেটে পড়ল। আমার জীবনে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আমি নারী - ভূমিকা - বর্জিত নাটকে অভিনয় শুরু করেছি....

বইটির ১৩৭-১৩৮ তম পৃষ্টায় লেখা আছে,

কেন,কেন এমন হলো বলতে পারো ? কে চেয়েছিল জীবনের প্রতিষ্ঠা ,অর্থ-যশে-প্রতিপত্তি.........
ঐ পোড়ামুখী হতভাগী মেয়েটা আমার জীবনে এলে কি পৃথিবীর চলা থেমে যেত? চন্দ্র-সূর্য ওঠা বন্ধ হতো?
মাঝে মাঝে মনে হয় কালাপাহাড়ের মত ভগবানের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিই। মনে হয় মন্দির-মসজিদ-গীর্জাগুলো ভেঙে দিই! আমাদের মতো অসহায় মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার ভগবানকে কে দিল? মায়ের কোল থেকে একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নেবার অধিকার কে দিয়েছে ভগবানকে? ........।


১৪২ তম পৃষ্টায়

ভগবানের ব্যাংকে আমার অদৃষ্টের যে পরিমান আনন্দ জমা ছিলো আমি বোধহয় তার চাইতে অনেক অনেক বেশি আনন্দের চেক কেটেছিলাম । তাই বোধহয় এখন সারাজীবন ধরে চোখের জলের ইনস্টলমেন্টে দিয়ে সে দেনা শোধ করতে হবে।

***বইটি আশা করি আপনাদের সবার ভালো লাগবে***




চিতা বহ্নিমান

লিখেছেন : ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
দি স্কাই এর প্রথম সংস্করণ মে-২০০০ইং(বাংলাদেশ)
বইটির মূল্য : ৫৫ টাকা মাত্র।
বইটির ধরন : দাম্পত্য জীবনের অসাধারণ প্রেমের কাহিনী।
**কলকাতা ও বাংলাদেশে বইটির অনেক সংস্করণ রয়েছে**


বইটি নারী কেন্দ্রিক হলেও এখানে পুরুষের চরিত্রের একটি জটিল ও কঠিন রুপ আছে।

বইটি সাধু ভাষায় লেখা হলেও আপনাদের ভালো লাগবে কেননা এখানে শিক্ষনীয় অনেক কিছু আছে।

চিতা বহ্নিমান্‌ বইটির কিছু অংশ এখানে দেয়া হলো ঃ

বইটির ৯ম পৃষ্টায় লেখা আছে ,

যে আমাকে কুৎসিত দেখে ভালোবাসলো না সে আমায় সুন্দর দেখে ভালোবাসতে পারে না। যে আমায় মুর্খ ভেবে গ্রহণ করলো না, আমাকে পান্ডিত্য দেখে গ্রহন করবার অধিকার তাহার নেই।

বইটির ৫৯তম পৃষ্টায় লেখা আছে ,

তপতীর সঙ্গে সঙ্গে মনে হইলো কাটার যে জাল সে এতকাল ধরিয়া নিজের চারদিকে বপন করিয়াছে তাহা হইতে মুক্তি পাইতে হইলে একটু আধটু তো ছিড়িয়া যাইবেই।

***
নারী চরিত্র যে, কি হতে পারে তা বুঝবেন ! নারী চরিত্র গুলো বইটিতে দারুন সাবলীল ভাষায় বর্ননা করা হয়েছে। বইটি পড়ে লেখিকা কে একটা ধন্যবাদ জানাতে আপনার ইচ্ছে করবে। নারী বিরহ যে কি কঠিন হতে পারে তা বুঝবেন । আমি অনুরোধ করছি মেয়েদের কে আপনার যারা এখনও বইটি পড়েননি প্লিজ পড়ে ফেলুন।
একটা কঠিন সংকল্প ,একটা কঠিন ভালোবাসা , একাল সেকাল সব মিলিয়ে অসাধারণ একটি বই।
***



গোধূলিয়া
লিখেছেন : নিমাই ভট্টাচার্য
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ১৯৭৬ ইং
প্রকাশনায় : দে’জ পাবলিশিং কলকাতা ৭০০০৭৩।
মূল্য : ৮০ টাকা মাত্র।
বইটির ধরন : একাটি অন্যরকম প্রেমের কাহিনী।

  গোধূলিয়া বইটির কিছু অংশ এখানে দেয়া হলোঃ

বইটির ২৫তম পাতায় আছে ,

একবার চোখ তুলে ওর হাসিমুখ দেখে মুখ বুজে ওর পিছনে পিছনে চললাম। সরু গলি । পূণ্য লেভাতুর বিধবার দল আমাকে এড়িয়ে চললেও মিনিটে মিনিটে ষাঁড়ের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিলাম । হাজার হোক কলকাতার ছেলে। মানুষের ভিড়ে হাটাচলা করার অভ্যাস থাকলেও গায়ের উপর ষাঁড় এসে পড়লে ভয় না করে পারি না ........
দেবযানী হয়তো বুঝতে পেরেছিলো ।
তাই তো বললো , আপনাদের ত অভ্যাস নেই তাই ষাঁড় দেখতে অস্বস্তি হয় । দু-চারবার কাশী এলেই আর অস্বস্তিবোধ করবেন না।
আমি শুধু বললাম, বোধহয়।
দেবযানী, একটু হাসতে হাসতে বললো, এখানে কথায় আছে-
রাঁড়,ষাঁড়,সিঁড়ি,সন্ন্যাসী
চার বাঁচিয়ে বাস কর কাশী।
আমি হাসতে হাসতে বললাম,দেখছি এখানে সবকিছু ব্যাপারে হয় একটা সংস্কৃত শ্লোক,না হয় একটা ছড়া শুনতেই হবে। আসল কথা,ভাগ্যবানের কিনা হয়,অভাগার কিনা ভয়।

বইটির ৪৬তম পাতায় আছে,

.......যে কোন মেয়ের জীবনেই প্রথম পুরুষ হচ্ছে বাবা। এরপর আরো অনেক পুরুষেরা তার জীবনে আসে ভীড় করে । আমার জীবনের সেই পুরুষই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমার মা মারা যাবার পর আমাকে অদৃষ্টের খেয়াঘাটে ফেলে তিনি তার জৈবিক চাহিদা মেটাবার জন্য অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে এক যজমান কন্যাকে নিয়ে নতুন সংসার পাতলেন। তাই তো শৈশব থেকেই পুরুষ মানুষ সম্পর্কে আমার বিতৃষ্ণা,ঘেন্নাও বলতে পারেন।

বইটি’র কিছু বাক্যঃ-

* “পুরুষরা মন থেকে যত তাড়াতড়ি সবকিছু মুছে ফেলতে পারে মেয়েরা তা পারে না।”
* “মন যুক্তি বোঝে হৃদয় তো বুঝে না ”


বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোঃ

বইটি পড়লে আপনার এক ঘেয়েমি লাগবে না পড়তে পড়তে কখন যে আপনার সময় কেটে যাবে টের পাবেন না।
মাঝে মাঝে আপনার মনে হবে আসলে ভালবাসা কেন এমন হয়..........?
একজন বিধবা’র প্রেম আর সামাজিক চাপ সব মিলিয়ে ভালো লাগার মতো একটা উপন্যাস।


জুলভার্ন ভলিউম-১
আশিদিনে বিশ্ব ভ্রমণ (সেবা প্রকাশনী থেকে ১ম প্রকাশঃ ১৯৭৯ )
নাইজারের বাকে (সেবা প্রকাশনী থেকে ১ম প্রকাশঃ ১৯৮২ )
মরুশহর (সেবা প্রকাশনী থেকে ১ম প্রকাশঃ ১৯৮২ )
-------------------------------------------------------------------------
বইগুলোর লেখকঃ জুলভার্ন
বইয়ের ধরন কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী
তিনটি বইয়ের মুল্যঃ একসাথে ৪০টাকা মাত্র
সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত
অনুবাদঃ শামসুদ্দিন নওয়াব


আশিদিনে বিশ্ব ভ্রমণ

আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ বইটিতে দারুন ভাবে বর্ণণা করা হয়েছে বিশ্ব ভ্রমনের কথা ,সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে লেখা এই বইয়ে তৎকালীন ভারতবর্ষের কথা উল্লেখ্য করেছেন। আরো চমকপ্রদ বিষয় হলো লেখক কখনই ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেননি তবুও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সাবলীল ভাবে।
*ফিলিয়ান ফগ কে দিয়ে তিনি বিয়ে করিয়েছেন ভারতীয় বিধবা নারী আউদাকে।

নাইজারের বাকে
আফ্রিকা অভিযানের এক লোমহর্ষক বর্ণনা করা হয়েছে এই বইয়ে বইটি একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠা মুস্কিল। সবচেয়ে আশ্চর্য কথা হলো লেখক এতো র্নিভূল ভাবে লিখেছেন যে মনে হবে আপনিও বুঝি চলেছেন তাদের সাথে। সেই সাথে জানতে পারবেন তখনকার সময়ে নিগ্রোরা কিরকম ছিলো।

মরুশহর

মরুশহর বইটি নাইজারের বাকে বইটির পরবর্তী অংশ, এই বইটিতে আপনি পাবেন সাহারা মরুভূমি কে নিয়ে লেখা দারুন থ্রিলার এ্যাকশন এক কাহিনী আর তাছাড়া এখানে যে চরিত্র গুলো আপনি পাবেন তাদের যে কোন একটা চরিত্রে নিজেকে ভাবলে আপনার দারুন মজা লাগবে। বইটি লেখার সময় কালে টেলিগ্রাফের কথা উল্লেখ্য করা আছে কিন্তু তখন পর্যন্ত টেলিগ্রাফ আবিস্কার হয়নি।

** জুলভার্নের লেখা বই গুলো আসলেই দারুন মজার আশা করি আপনাদের ভালোলাগবে**



পরিশেষে:

* যারা উপরে উল্লেখিত বই গুলো পড়েছেন তারা তাদের অনুভূতি গুলো ব্যাক্ত করুন।

** যারা এই বই গুলো পড়েন নি তাদের কে অনুরোধ জানালাম সময় পেলে একবার পড়ে নিবেন।

হয়তো বই পরিচিতি দিয়ে গিয়ে আমার লেখার বিন্যাসে কোথাও কোথাও ভূল হয়েছে তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমার এ লেখাটি যদি আপনাদের কাজে লাগে তাতেই আমার সন্তুষ্টি.....................

সিনেমার মতো প্রেম






কাল থেকে দুপুর হয়ে গেল তবু রোদের দেখা নেই। ধোয়াটে কুয়াশা সাদা রুমালের ন্যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাশবন ও ব্রহ্মপূত্রের দু’তীর ধরে নেচে যাচ্ছে। শীত গেছে ফাগুন এসে গেল বলে তারপরও শীতের কমতি নেই। নচ্ছার কুয়াশা ধোয়ার পদাবলী খুলে বসেছে যেন; সাঁঝ-সকালে অবিরাম পড়তে থাকে। শীত দুপুরে জানালা খুলে দাড়িয়ে ছিল বাবলী। সিডি প্লেয়ারে তখন বাজছে “ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে” গানটা রিপিট করা আছে বলে বেজে যাচ্ছে একটানা। পাশের ঘরে আধবোজা চোখ নিয়ে শুয়ে ছিলেন বাবলীর মা সুহিনা বেগম। কানে লাগছিল গানটা! ঘুম চোখ নিয়ে উঠে এলেন। বিরবির করে বলতে লাগলেন, প্রতিদিন এক গান কতবার শুনে বাবলী?
-এবার না হয় বন্ধ কর? সেই কখন থেকে শুনছিস? খুব মন খারাপ তোর? বলতে বলতে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বাবলী এতটাই তন্ময় হয়ে ছিল যে শুনতেই পায়নি। মেয়ের এমন তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা বেশ ক’দিন ধরেই দেখছেন তিনি। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে না। এখনকার মেয়ে-ছেলেদের কোন কিছুতে জোর করাটা বৃথা। সে চেষ্টা থেকে তিনি তাই বিরত থাকেন।

সুহিনা বেগমের তিন মেয়ে। স্বামী গত হবার পর থেকে তার রেখে যাওয়া স্থাবর-অস্থাবর থেকে যে টাকা আসে তাতে দিব্যি চলে যায় সংসার। তিন মেয়ে। বড় মেয়ে রুপালীর গেলো বছর বিয়ে হয়ে গেল। বর খুজতে হয়নি, নিজেই খুজে নিয়েছে। ভালো-খারাপ বলবার সুযোগ দেয়নি; ছেলে কম্পুটার ইঞ্জিনিয়ার ব্যাস্ বিয়ে দিতেই হলো। ছোট মেয়ে দিয়ালী সব-সময় ভাবগম্ভীর হলেও কথা বলতে গেলে হাজারটা যুক্তির খেল্ দেখায় ওকে নিয়ে চিন্তার কোন নেই। মেঝো মেয়ে বাবলী। একটু আলাদা, মিশুক এবং চঞ্চল। সুহানি মেয়েদের বয়েস বাড়বার পর থেকেই কিছুটা চিন্তিত বিয়ে দিতে পারলেই তবে স্বস্তি মিলবে।

বুবন গানের ক্লাস থেকে ফিরে শুয়েছিল বিছানায়। ঘুম নেই বলে শুধু শুধু শুয়ে থাকা। র‌্যাকের উপর থেকে উঁকি দিচ্ছে এরিখ সেগালের লাভ ষ্টোরি। পড়া হয়ে উঠেনি। সকালের রোদের পর দুপুর রোদেও বিছানা ছাড়ার ইচ্ছে হলোনা ওর। ইচ্ছে গুলো পর হয়ে যাচ্ছে। বাবলীকে সাহস করে ভালবাসি বলবার পর থেকেই এমনটার শুরু। ছ’মাস ধরে ছিল অপেক্ষা, তারপর বলা! মানুষ কেন প্রেমে পড়ে? কেন ভালোবাসে? কেন? অনেকগুলো উত্তর মাথায় এলেও তার কোন উত্তর খোঁজা হয়ে উঠেনি। আবেগে জীবন না চললেও থেমে থাকেনা, আবেগ জীবনগাছের আশ্চর্য এক ফুল। জীবনের শোভা বাড়াতে তার প্রয়োজন কম নয়। বুবনের কাছে ভাবনা দমিয়ে রাখা দায়! আর সেজন্যই বাবলীকে সোজা-সাপ্টা বলবে বলেই বেড়িয়ে পড়লো।

কমন রুমের জানালায় হাত ইশারায় ডেকে বললো, “বাইরে এসো কথা আছে”। বাবলী বেড়িয়ে বললো এখানে বলবে? নাকি ক্যান্টিনে বসবো। বুবন চা খাবার অফার করলো। টেবিলে হাতের বইগুলো রেখে বুবনের দিকে তাকিয়ে দেখল ও নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, নিরবতা ভাঙতেই বললো, “ কি বলবে বলো? চা খেতে নিশ্চয় ডাক নি?”
-খানিকটা সে রকমই।
-যাই হোক খানিকটা সেরকম, পুরোটা তো আর না। তা বলো শুনি? কেন ডাকলে?
বুবন মনে মনে ভাবছে মেয়েটা কি-না কি মনে করে? মাইন্ড করে বসবে না-তো! রিফিউজের খবর সবাইকে বলে বেড়াবে না-তো আবার- “জানিস রন্টি, বুবন উজবুকটা আমাকে প্রেমের অফার দিয়েছিল” দিয়েছি মুখে ঝামা ঘষে, দারুন হয়েছে না? ব্যাটার পিরিতের শখ। এমন কিছু বলবে না তো আবার। মাথা নিচু করে এগুলোই ভাবছিল। মাথা তুলবার আগেই টেবিলে চা চলে এলো। তিতকুটে চা মুখে নিয়ে বুবন বললো- বাবলী আমি তোমাকে ভালবাসি? যাকে বলে রিয়েল লাভ; নো ফান! সারা জীবন একসাথে থাকার অভিপ্রায়।
কথা কর্ণপাত হবার পর প্রায় দশ সেকেন্ড মুখ হা-করে বসে রইল বাবলী। বুবনের মতো বাস্তববাদী ছেলে শেষে আবেগের মালা গলায় দিল। কিভাবে হলো এমন? আরো দু’মিনিট চুপচাপ বসে রইলো ওরা দুজন। মুখ ভর্তি করে চা খেয়ে নিয়ে বাবলী একটু বিস্ময় চোখে নিয়ে বললো, বুবন আমাকে ভালবাসবে তুমি? ভাবনায় আসছে না আমার? ঠিক করে বলছো তো? এটা কোন এক্সপেরিমেন্ট নয়তো?
বুবন পর-পর দু’বার মাথা নেড়ে বললো না, না, কোন এক্সপেরিমেন্ট নয়। বাবলী চোখ বন্ধ করে মিনিট খানিক ভাবলো তারপর বললো-হ্যা; তোমাকে ভালবাসতে পারি তবে একটা শর্ত আছে? ভালোবেসে যেহেতু দুজন একসাথে বাঁচবো সেহেতু যেকোন কারণে বা অকারণে হোক আমার সাথে মরতে পারবে তুমি?
এবার বুবন ‘থ’ হয়ে গেল। বলে কি! একসাথে কি কখনো মরা যায়? আগে-পিছে হতে পারে। তাছাড়া ভালোবাসার জন্য মরে যাওয়া। এসব প্রেম-ট্রেম করে বুবন মরে গেলে জগতে নতুন কোন অমর প্রেম কাহিনী নিশ্চই হবে না! বেহুদা মরে কি লাভ? থাক্ প্রেমের প্রয়োজন নেই। বাবলী টেবিল ছেড়ে উঠে যাবার পর বুবন বাড়ি ফেরে সেই থেকে ভাবছে; মরণ তো আর অত সোজা না! আবার খুব কঠিনও না অন্তত ভালোবাসতে পারার চেয়ে মরন সহজ। কিন্তু বাবলী অমন কঠিন কেন?

বন্ধুরা বললো বাবলী তোকে ঢপ মেরেছে। দেখ-গিয়ে আর কারো সাথে....। -বুবনের চোখে ঘুম আসেনা। ভাতঘুমও চোখ থেকে হাওয়া, চারপাশটায় বাবলীর ছায়া তাড়িয়ে ফেরে। ভালোবাসা পেলে বেশ হতো না পেলে মনের ভেতর থেকে কোন তাগিদ আসেনা। মেঘের মতো ছুটে গিয়ে বাবলীর দিগন্তে হারাতে পেলে মন্দ হয় না। বাবলীর চোখ, হাসি, কথাবলায় অদ্ভুত আশ্চর্য ফরিঙ উৎসব! দুজনে আশ্চর্য ভাবে এক হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে দুঃখও ভেংচি কেটে পালিয়ে যাবে। কিন্তু একসাথে মরতে বলে যে!
বাড়ি ফিরে অন্যদিনের চেয়ে একটু আলাদা হয়ে গেছিল বাবলী। এতদিনকার “ঘরেতে ভ্রমর এলো গুন-গুনিয়ে” গান পরিবর্তন হয়ে তার বদলে বাজলো “খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি মনের ভেতরে” দিয়ালী বললো “তোকে আজকে উড়– উড়– লাগছে; ব্যাপার কি-রে? নতুন কিছু কি হলো?” বাজে বকাস না-তো? নতুন কিছু কি হবে? তুই যা ভাবছিস তা কিচ্ছু না।
মুখে কিছু না বললেও এরই মধ্যে ও ভেবে নিয়েছে বুবনকে সে ভালবাসবে। কাউকে ভালবাসবে বা কারো প্রেমে পড়ে যাবে সিনেমার মতো করে, এসব নিয়ে ভাববার কোন কারন এর আগে হয়নি। শুধু জানতো একদিন প্রেম আসবে, নিয়মের হাত ধরে। ছাপিয়ে দিয়ে যাবে সব। প্রেমের ঢেউয়ে হয় ভেসে যাবে, নয়তো ডুবে যাবে। একটা কিছু হবে; সিনেমার মতো শুরু হয়ে, গল্পের মতো প্রেম আসবে। বুবনকে উপেক্ষা করার কোন মানে নেই তার ওপর আবার প্রথম প্রেমের আহবান বলে কথা! বুবন একটু ক্ষ্যাপাটে! তার উপর আবার মাঝে মাঝে সব কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার খুব শখ। বাবলী মনে মনে বললো যাই হোক দেখাই যাক না কি হয়!

সেদিন কলেজ ক্যান্টিনে বুবনকে কিছু না বললেও সেই ক্যান্টিন থেকে ভালবাসার শুরু হয়ে গেল। কিউপিডের তীর দুজনকে তাড়িয়ে ফিরল ক্যান্টিন থেকে কলেজ মাঠ, সার্কিট হাউসের লম্বা লনের ধার, জয়নুল আবেদীনের গ্যালারী। ছুটির দিনে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বসে লম্বা প্রেমালাপ। অদৃশ্য তরঙ্গ ধরে প্রেমপর্ব উঠে আসে বন্ধুদের আড্ডায়, পারিবারিক চায়ের কাপে। বুবনের মা সহেলী’ একদিন সাহস করে বলেই ফেললেন ছেলেকে
-বুবন তুই নাকি প্রেম করছিস?
-হুম!
-মেয়েটা ক্যামন?
-সাধারণ
-সাধারণ তো বুঝলাম। ওর বাবা-মা কিছু বলছে না, তোর সাথে ঢ্যাং-ঢ্যাং করে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে? সব উচ্ছনে গেছে।
-ও ঘুড়ছে না; আমি ঘুড়ছি ওর সাথে। ওর বাবা নেই। মা মেয়েকে নিয়ে অত চিন্তিত না! মেয়ে তো আর উচ্ছন্নে যাচ্ছে না। তাছাড়া প্রেম করলে কেউ কি উচ্ছন্নে যায়?”
-আনন্দের প্রেম কোনদিন নিরানন্দ হয়ে গেলে পরে বুঝবে। আবেগে মন চলতে পারে কিন্তু জীবন সে-এক আজব নদী।
মায়ের কথা বুবন বুঝে কিন্তু মন হলো বড় অদ্ভুত এক আশ্রম; যার দ্বার খোলা কিন্তু বেড়িয়ে যাবার পথ বন্ধ। প্রেমের মরণ হলে পৃথিবী থেকে প্রেম ফুরিয়ে যেত। প্রেমের মরণ নেই, তাই ফুরিয়ে যাবার ভয় নেই। প্রেম পর্বের পাতা দীর্ঘায়িত হচ্ছিল এভাবেই। বাবলী ঠিক করে নিয়েছিল; পড়ালেখার পার্ট চুকে গেলে ঠিক বিয়ে করে ফেলবে তারপর জব। বুবনের অবশ্য তাতে কোন আপত্তি নেই। মা’কে একটু ম্যানেজ করতে হবে আরকি!

সেদিন ভোর কুয়াশায় বাবলী বেড়িয়ে ছিল টিউশনের উদ্দেশ্যে। অত সকালে রিকসা থাকেনা। হেটে যেতে হয়; তাতে অবশ্য আপত্তি নেই ওর। মাঝে মাঝে বুবন দাতে ব্রাশ চেপে সঙ্গ দেয়। শুনশান রাস্তায় একলা চলা ঠিক না। মা প্রায়ই বলে, কিন্তু অত ভাবলে জীবন চলে না। সংসার নিয়ে মা’র কম ভাবনা নয় তাতে একটু হাত দিতে পারলে ভালো লাগে। সকাল থেকে বা চোখটা লাফাচ্ছে ওর। কলেজ মোড় থেকে পায়ে হেটে সারদা রোড অবধি যেতে হবে; শর্টকার্ট করে গলির ভেতরে ঢুকে পড়লো বাবলী। মা’কে নিয়ে ভাবনা যতো তার’চে বেশি দিয়ালীকে নিয়ে ও মেয়ে কোন ছেলেকেই বিশ্বাস করতে পারেনা। এমন হলে চলে, সংসার জীবনে গিয়ে কি করবে কে জানে। এসব ভাবতে ভাবতেই পথ চলছিল বাবলী অন্ধকার গলির শেষটায় আসতেই পেছন থেকে হঠাৎ যে যেন জাপটে ধরলো! রাস্তাটা সকালের দিকে নিরব থাকে এখানে খালি বিল্ডিং ছাড়া কোন বসতি নেই যে চিৎকার দিলে কেউ ছুটে আসবে।
ও পিছু ফিরে আক্রমনকারীর মুখটা দেখবার আগেই সাদারঙের ওষুধটা নাকে লাগলো। মাথাটা দুলে উঠে চোখ ঝাপসা হয়ে পড়ে গেল। এর পর অনেকটা সময় অচেতন! কিচ্ছু মনে নেই। একটা ভয়ঙ্কর ঘোরের মধ্যে শুধু গোঙ্গানির শব্দ ছাড়া বাকী সব অচেনা। যখন চোখ খুলে চাইলো তখন নিজেকে অচেনা আধপাকা বিল্ডিং ঘরের নোংরা বিছানায় আবিস্কার করলো। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথাটা আগের চেয়ে বেশি রকমের দুলে উঠলো। মনে হচ্ছে কোমর থেকে নেমে গেছে বিষধর সাপ। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো! বুঝতে পারলো, গেছে সব! অনেকক্ষণ কাঁদল আশে-পাশে কেউ নেই শুধু ঘরে টিউব লাইট জ্বলছে। বুবন আর মা’ কে কি বলবে সে? এখন দু’ চোখ খুলে পৃথিবী দেখার চেয়ে সিলিংফ্যানে ঝুলে গেলে বেশ হয়।

তিনদিন পর সন্ধ্যে বেলায় হাসপাতাল থেকে সিএনজি বাবলীকে উঠোনের দোরগোড়ায় ফেলে রেখে গেল। সুহানী বেগম ব্যাপারটি আচঁ করতে পেরেছিলেন ঘটনার দিন সন্ধ্যেয়। গলা চিড়ে কান্না এলেও কিছু করার ছিলনা। থানা-পুলিশ করা হয়েছিল। যদিও এসব ব্যাপারে পুলিশ বড় উদাসীন। থানার দারোগা বাবুর অতিরঞ্জিত প্রশ্নে তিনি শুধু বিচলিত হন নি মনে হয়েছিল এর’চে মরণ ভালো। বুবনকে একদল পুলিশ এ কাজেই সন্দেহ করে ভীষন ভাবে ঠেঙ্গিয়েছে সে এখন হাসপাতালে। বাবলীকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। সে সুযোগ পায়নি। কলেজ থেকে চাপ ছিল সন্দেহভাজন সবাইকে ধরার এবং অদ্ভুত কাণ্ড ছিল এই, সন্দেহের তীরটা বুবনের দিকেই বেশি ।

মেয়েকে নিয়ে যখন দুর্বিপাকে সুহানী বেগম তখন বুবনের গ্রেফতারের খবরে আরও মুষড়ে পড়েছিলেন। পাঁচটা লোকের কথার উত্তর দেয়াটা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক! তার মর্মার্থ তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। থানা থেকে বাড়ি ফিরবার পর সমাজ-সংস্কার নিয়ে যতটা ভয় তিনি করছিলেন তারচে বেশি ভয় ছিল বাবলীকে নিয়ে। উঠোন থেকে দিয়ালীই বাবলীকে ঘরে পৌছে দিল ও অবশ্যি কারো সাথে কথা বলেনি। আর কেউ জিজ্ঞেসও করেনি কিছু। আজ নিয়ে তিনদিন পার হলো। যখন উদ্ধার করা হয়েছিল তখনও কিছু বলেনি। হাসপাতালেও মুখে কোন কথা ছিলনা। আজ ঘরে ঢুকবার পর শুধু ছিটকিনির আওয়াজ শোনা গেছে।

বুবন হাসপাতালে শুয়ে জানতে পেল বাবলী বাড়ি ফিরে গেছে। যত দ্রুত সম্ভব পুরোটা জানতে হবে। এ ঘটনার পর মা হয়তো কিছুতেই মানতে চাইবে না। বন্ধু-বান্ধব, সমাজ সে-তো মহা হ্যাপা, কি যে করা যায়? তবে যাই হোক বাবলী তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেই কিন্তু ভালবেসেছে। এখনও বাসে। ওকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবাটা অন্যায় হবে। বাবলী ঠিক ধরে নেবে এটা সত্যিকারের ভালবাসা ছিলনা হয়তো এটা এক্সপেরিমেন্ট ছিল। দুর্ঘটনা হতেই পারে তাই বলে ভালবাসাকে বদলে ফেলা অসম্ভব।
সে রাতে ঘুমুতে পারেনি বুবন। অজানা অস্থিরতায়। ঘুমুতে পারেনি সুহানী বেগমও। ও ঘরে মেয়ে কি করছে কে-জানে? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে ছিলেন ভোরের দিকে হঠাৎ দরজায় বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। দিয়ালী কাঁদছে- “মা আপুর কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে কি আপু?”
হুড়মুড়িয়ে উঠে দরজা খুলে দিয়ালীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন তিনি। দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকবার পর দেখা গেল বাবলী খুব শান্ত হয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে; ওড়না ঝুলে রয়েছে গলার কাছে।

বুবনের সাথে শেষ দেখা হয়নি বাবলীর। হাসপাতালের বেড থেকে মা সহেলী বেগম উঠতে দেয়নি। কলেজের মাঠ ও বকুল তলা হয়ে বাবলীর মরদেহটা অনেক পথ ঘুরে শেষে পুরোনো গোরস্থানের দূর্বাঘাস মাটিতে ঘুমিয়ে গেল সব-সময়ের জন্য। সাংবাদিকের দল ভীড় করেছিল বাড়ির উঠোনে দিয়ালী ক্ষেপে সবকটাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। সুহানী বেগম পর-পর মুর্ছা গিয়েছিলেন। রুপালী শুধু অনঢ় ছিল সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছিলেন আনটোল্ড কোন স্টোরি যেন পত্রিকায় না ছাপায়।

সেই সকালে হাসপাতালে রুমকে উত্তাল কান্নাঘরে পরিনত করে দিয়েছে বুবন। ওর কান্না আর চিৎকারে আশ-পাশের মানুষগুলো পর্যন্ত কাঁদল। বিকেলের দিকে গলায় আর স্বর ফুটছিল না। বুবনের শুধু বলছিল এ জীবন আমি চাইনা! আমি বাবলীকে চাই! অন্ধ প্রেম ওকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল প্রতিটি মুহুর্তে । জানা গেল না বাবলীর মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? বুবন ভাবছিল কোন অশুভ চক্রের লিপ্সার জন্য আজ তার জীবনে শূন্যতার কালে মেঘ ক্রমাগত ছড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক রকম প্রশ্ন গুলো বুবনকে চক্রাকারে আঘাত করতে লাগলো ক্রমাগত।

কলেজের ছাত্র-ছাত্রীর দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল বুবনকে দায়ী করছিল, আরেকদল দায়ী করছিল অনাকাঙ্খিত কিছু নামধারী ছাত্রদের। তবে আসল সত্যিটা অদৃশ্য হয়েই রইল। বুবনের অন্ধ প্রেম কয়েক ঘন্টার মধেই শহুরে অলি-গলিতে কেচ্ছার মতো রটে গেল। পত্রিকায় এলো, প্রেমের জন্য প্রেমিকা ধর্ষিত অতঃপর আত্মহত্যা। খবরের কাগজ পড়বার পর সহেলী বেগম বুবনকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো সারাটা দিন পড়ে রইলেন হাসপাতালের বেডে। উনি বুঝতে পেরেছিলেন কিছুতেই একা ছাড়া যাবেনা ওকে। একটা কিছু অঘটন যদি হয়ে যায়! কিন্তু সন্ধ্যের দিকে ঘুম ভেঙ্গে যখন দেখলেন বুবন নেই তখন কি করবেন ভাবতে পারছিলেন না। দু’ হাত তুলে শুধু চিৎকার করলেন খানিকটা সময়। নার্স কিছু বলতে পারলো না। তিনতলার বারান্দায় এসে যখন দেখলেন মানুষের জটলা তখন বুঝতে বাকী থাকলো না কি হয়েছে। বারান্দায় এসে নিচের দিকে তাকাবার আর সাহস পেলেন না।
বুবন যখন হাসপাতালের ছাদ থেকে পাখির মতো উড়ে নিচের দিকে পড়ছিল তখন ওর কানে শুধু একটা কথাই বাজছিল- “বুবন তোমাকে ভালবাসতে পারি, কিন্তু কারণে বা অকারণে হোক আমার সাথে মরতে পারবে তুমি? বুবন হয়তো একসাথে পারেনি তবে খুব বেশি দেরিও করেনি মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধান ছিল! ছাদ থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে পাখির মতো ঝাঁপ দিয়েছিল বুবন। ও যখন উড়ছিল তখন দেখছিল বাবলী ওকে দু-হাত তুলে তাকে ডাকছে।




                            ==============সমাপ্ত=============

মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৪

একদিন কবি ও শিল্পী





অর্ধনগ্ন প্রচ্ছদ দেখিয়ে আর্টিস্ট বললেন,
এটা শিল্প!
নগ্নতাও একটা শিল্প! ক’জন পারে এমন?
ক’জন মকবুল ফিদা, পিকাসো বা ভিঞ্চি হতে পেরেছে?

আমি মলাটে মলাটে শিল্প খুজিঁ!
লেখাগুলো যতটা না শৈল্পিক তারচে’ মলাট বেশি।
বেখাপ্পা শিরোনাম শুনে চমকে গেলে টেবিলের চা উঠবে ছলকে!
তা আর হয় না।
শিরোনাম গুলোও শৈল্পিক-
কবি বলেছেন।

কাব্যের গরু ঘাস খেতে যায় আকাশে-
জানতে চাইলাম কিভাবে সম্ভব?
কবি বললেন- এটা রূপক!

রূপকতা কবিতার মুন্সিয়ানা; ক’জন পারে এমন?
ক’জন বিষ্ণু দে, সমরেশ, জীবনানন্দ হতে পেরেছে?
আমি কবিতার স্তবকে স্তবকে রূপক খুজিঁ
বারংবার ব্যার্থ হই।
কবি বলেছেন-
উপযুক্ত; পরিপক্ক বা কবিতার উপযোগী পাঠক হাতে গোনা।

কবিগন সৃষ্টিতে আনন্দিত, শিল্পীর সৃষ্টিতে বিস্ময়!
পাঠক শ্রোতা তো নচ্ছার!

∞ কবিতাঃ ফা গুন আ সে নি ∞





তোকে দেখিনি !
কতদিন, হিসাব করা হয়ে উঠবে না কখনো;
হতে পারে দিন-মাস বা আরো বেশিক্ষণ;
কিংবা হতে পারে এক আধ-বছর,
কিংবা একযুগ কিংবা তারও বেশি।

ভ্রান্তির ক্রান্তি জাল গায়ে আঁকা,
কত হয়েছে ভুল হিসেব করা হয়নি;
হতে পারে দু’একটা বা আট-দশটা,
কিংবা হতে পারে শতেক কিংবা সহস্র,
কিংবা লক্ষাধিক কিংবা তারও বেশি;

ফাগুন আসেনি;
কতদিন পেরুলো; বলা মুস্কিল
হতে পারে অষ্টাদশ বয়সে শুরু বা উনিশ-কুড়ি,
কিংবা,দ্বাদশ-ত্রয়োদশ বয়সে কিংবা, পঞ্চদশ-অষ্টাদশ;
কিংবা, ত্রিশোর্ধ্ব কিংবা, তারও বেশি।

নরম পালক নিয়ে বুকে;আছিস সুখে;
শুকতারা হাতে; চন্দ্র কপালে;
বিশেষণে আরও কত কি?

যদি নদী হতে চাস কখনো;
কাছে ডাকিস;
কুরুক্ষেত্র হব না।

রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৪

রাগভাঙ্গা শহর



রাগভাঙ্গা শহর
তোমাকে নিয়ে শেষ কবে স্বপ্ন দেখেছিলাম মনে করতে পারছিনা। মনের কি দোষ দেব বলো?
তোমাদের রাগভাঙ্গা শহরেই তো বেঁচে দিয়েছিলাম তাকে।
এখন তোমার সাথে যে কথা কব’ সে- জো’ পর্যন্ত নেই, তোমাকে বেধেছে সংসার আর আমাকে বেধেছে শিকল!
সমাজের মুখ অগ্নিগিরির চেয়েও বড়ো।


অথচ-
তাকিয়ে দেখি বেড়ালের নাকের নিচে গোঁফ; ঠিক আমার মতো। এ-বেলা, ওবেলা শাপ-শাপান্ত করি, শুধু না বলে খেয়ে নেয় বলে। অথচ আমি তুমি রোজ না হলেও মাসান্তে চুরি করি, এই-সেই যা-তা।



না-নারী, না-নীরা
যদি নারী হতে তবে তোমার চোখে থাকত মেঘের বসত-বাড়ী,
যদি নীরা হতে তবে তোমার চোখে থাকতো প্রেমের তরবারি
তুমি কোনটাই হতে পার নি;
না-নারী, না-নীরা।




:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::

রচনাকাল
২০ মার্চ-২০১৪ খ্রিঃ
মীরবাড়ি, মাতৃছায়া
ময়মনসিংহ

শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৪

রঙে রাঙানো রঙকাব্য


♣____ 

প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই রঙ আছে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য রঙের মানুষ। “রঙ হীন” মানুষের জীবন হতে পারেনা। শৈশবে দুধের মতো সাদা রঙে আমাদের জীবন শুরু হয়। মায়ের চোখের জলের স্বচ্ছ কাঁচ রঙে আমরা প্রথম মায়া অনুভব করতে শিখি। বাবার মুখের সোনালী হাসিতে প্রথম বুঝতে শিখি উচ্ছাস!


♣____♣____

রঙের হাওয়ায় আমাদের কৈশর শুরু হয়। আমরা তখন সবুজে অবুঝ হয়ে ফরিঙের মতো উড়ি। সবুজের কাছ থেকে প্রথম দেখি প্রকৃতির নিজস্ব রঙ আছে। অপরিসীম সৌন্দর্য আমাদের চোখে ধরা দেয় আকাশী রঙা আকাশ হয়ে, যে রঙের কোন শেষ নেই। দুরন্ত বয়সে আমরা ঘুড়ির মতো উড়ি বনে-বাতাসে-নদীর ধারে। আমাদের চোখে তখন রঙ-বেরঙ এর মার্বেল বসত করে। অনেক ডোরাকাটা মার্বেল।


♣____♣____♣____
 

লাল-কালোয় সংমিশ্রণে শুরু হয় আমাদের তারুণ্য। শব্দকথায়, সুরের ভুবনে, ইচ্ছের প্রজাপ্রতি সবকিছুতেই তখন কল্পনার সব রঙ নিয়ে এসে চোখের সামনে খুলে দেয় আপন জানালা। আমরা ভাসি আনন্দে-ব্যাথা-সংশয়ে। আমরা বুঝতে পারি সব অনুভূতিরই রঙ আছে। গোলাপী রঙা আবেগ আমাদের ভাবতে শেখায়, মনখারাপ করতে শেখায়। অযথাই উড়তে শেখায়। কিউপিডের প্রেম তীর আমাদের প্রেমী করে তোলে। প্রদীপের হলুদসোনা রঙে আমরা নিজেকে সঁপে দেই প্রেমের কাছে। তারুণ্যের সেই সব দিন-রাত্রীতে নিঃ সঙ্গের কালো রঙের সাথে আমরা সখ্যতা গড়ে তুলি অজানা বোকামির কমলা রঙে আর কান্নার কাঁচ রঙে আমরা পুনরায় রাঙ্গিয়ে নেই নিজেকে।


♣____♣____♣____♣____
 

রঙের দুর্বার আন্দোলন আসে মধ্য বয়সে। মধ্য গগনের সুর্যের মতো কখনো তেজী, কখনো আবেগী। কাজের চাপে তখন বেগুনি রঙে কখনোবা ছেঁয়ে যাই আমরা। দাম্পত্য কলহের খয়েরী রঙে আমরা শাপ-শাপান্ত করি নিজেকে ও অন্যকে। এভাবেই ক্যালেন্ডারের রঙ পাল্টায় অনেক নাম না জানা রঙে দিনমান ঘটমান ঘটে চলে ভবিষ্যত। আমরা ভাসি এবং ডুবি বাদামী রঙে।
বার্ধক্যে আমাদের রঙের অভাব ক্রমশই ঝড় তোলে মনের আয়না। কত কিছু ফেলে আসা। কত কিছু ভুলে যাওয়া। কত কিছুর জন্য আফসোস। এসব ভাবনার রঙ নিজেকে বোকা মানুষের তালিকায় জুড়ে নেয়। প্রিয় মানুষের মুখের রুপালী হাসির রঙে কখনোবা সেসব ভুলে একটি দিনের জন্য বেঁচে থাকাটাই তখন ছাই রঙ মনে হয়। মৃত্যুতে শেষ দিনে আবার সেই জন্মের দুধ সাদা রঙেই নিজেকে করি সমর্পণ।


♣____♣____♣____♣____♣____
এই মানব জীবনের প্রতিটা মানুষের রঙ মিলে যায় তখন, যখন আমরা লজ্জায় লাল হই। বেদনায় হই নীল। শোকে কালো আর দু:খে ধূসর হই ।



               ________=♣=[]=♣=[]=♣=[]=♣=[]=♣=________


রচনাকাল
নয়ই আগষ্ট দুই হাজার চৌদ্দ খ্রিষ্টাব্দ
উইলকিংসন রোড, সুসং নগর